ইসলামী ব্যবসা-বাণিজ্যকে একটি সম্মানজনক এবং উত্তম জীবিকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে ব্যবসায় জড়িত ছিলেন এবং তাঁর সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই ব্যবসায়ী ছিলেন।
ইসলাম ব্যবসাকে
উৎসাহিত করে কিন্তু সেই সঙ্গে সততা, ন্যায়বিচার এবং ঈমানদারিতার উপর জোর দেয়। আজকের এই লেখায় আমরা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদিস নিয়ে আলোচনা করব, যা ব্যবসার জন্য একটি নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে।
এই হাদিসটি হলো:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ব্যবসায় লিপ্ত হয় এবং সততা ও ঈমানদারিতা পালন করে, তার জন্য জান্নাতের সাতটি দরজা খুলে দেওয়া হবে।” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল বুয়ূ’; হাদিস নং: ১০২)।
এই হাদিসটি ব্যবসার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়েরই উন্নয়নের পথ দেখায়। এটি শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, সকল মুসলিমের জন্য একটি জীবনধারার নিয়ম
এই হাদিসের মূল বার্তা হলো ব্যবসায় সততা এবং ঈমানদারিতা। ইসলামে ব্যবসা কোনো লোভের খেলা নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনীতে দেখা যায়, তিনি যুবককালে খাদিজা রা.এর ব্যবসা পরিচালনা করতেন এবং তাঁর সততার জন্য ‘আল-আমিন’ (বিশ্বস্ত) নামে পরিচিত ছিলেন।
এই হাদিসটি সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। ‘সততা’ বলতে বোঝায় ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে কোনো প্রতারণা না করা, দাম নির্ধারণে ন্যায়বিচার করা এবং পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করা। ‘ঈমানদারিতা’ বলতে আল্লাহর প্রতি ভয় এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধকে বোঝায়।
যখন একজন ব্যবসায়ী এই দুটি গুণ পালন করে, তখন তার ব্যবসা শুধু লাভজনক হয় না, বরং আল্লাহর রহমতের দরজা খুলে যায়। হাদিসে উল্লিখিত ‘জান্নাতের সাতটি দরজা’ এর অর্থ হলো আল্লাহর সেই বিশেষ অনুগ্রহ, যা সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ থাকে কিন্তু ঈমানদার ব্যবসায়ীর জন্য উন্মুক্ত হয়।
এটি একটি উৎসাহব্যঞ্জক বার্তা, যা ব্যবসায়ীকে বলে যে, দুনিয়ার লাভের পাশাপাশি আখিরাতের প্রতিদানও অপেক্ষা করছে। ব্যবসায় সততা পালন করা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ ইসলামে ব্যবসা সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি।
কুরআন মজিদে আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের সম্পদকে অন্যায়ভাবে না খেয়ে নাও, তবে যখন তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা হয় তখন তা হালাল।” (সূরা নিসা: ২৯)। এই আয়াতের সঙ্গে হাদিসটি মিলে যায়। ব্যবসায় প্রতারণা করলে সমাজের বিশ্বাস নষ্ট হয়, অর্থনীতি দুর্বল হয় এবং মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়ে। V
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরেক হাদিসে বলেছেন, “দুজন ব্যবসায়ী যখন মিলিত হয় তখন শয়তান তাদের মধ্যে প্রবেশ করে।” (সহীহ বুখারী)। অর্থাৎ, লোভ এবং প্রতারণার ফাঁদ এড়াতে সততা অপরিহার্য। আধুনিক যুগে, যেখানে বিশ্বায়নের কারণে ব্যবসা বিশাল আকার ধারণ করেছে, এই হাদিসটি আরও প্রাসঙ্গিক।
উদাহরণস্বরূপ,
অনলাইন কমার্সে পণ্যের ছবি এডিট করে বিক্রি করা বা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রতারণার উদাহরণ। একজন ঈমানদার ব্যবসায়ী এসব এড়িয়ে চলে এবং গ্রাহকের সন্তুষ্টির উপর জোর দেয়। ফলে তার ব্যবসা টেকসই হয় এবং সমাজে তার খ্যাতি ছড়ায়।
এই হাদিসটি ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবহারিক নির্দেশনাও প্রদান করে। প্রথমত, সততা পালন করতে হলে ব্যবসায়ীকে নিজের পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। যদি কোনো ত্রুটি থাকে, তা গ্রাহককে জানাতে হবে। দ্বিতীয়ত, দাম নির্ধারণে ন্যায়বিচার করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের মসজিদে এসে দাম নির্ধারণ করে, তার জন্য আল্লাহ তার ব্যবসায় বরকত দান করবেন।” (সহীহ মুসলিম)। এটি বোঝায় যে, অতিরিক্ত লাভের লোভ ত্যাগ করে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করলে আল্লাহ বেশি লাভ দান করেন। তৃতীয়ত, ব্যবসায় শর্তাবলী স্পষ্ট করতে হবে।
কোনো অস্পষ্টতা থাকলে তা পরিষ্কার করা উচিত, যাতে পরবর্তীতে বিবাদ না হয়। চতুর্থত, ব্যবসায় জাকাত এবং সদকা প্রদান করা ফরজ। এই হাদিসের আলোকে ব্যবসায়ীকে মনে রাখতে হবে যে, তার উপার্জনের একটি অংশ আল্লাহর জন্য। এতে তার ব্যবসায় বরকত বাড়ে এবং গুনাহ থেকে রক্ষা পায়।
আধুনিক ব্যবসায় এই হাদিসের প্রয়োগ দেখা যাক। ধরুন, একজন মুসলিম উদ্যোক্তা একটি কোম্পানি চালান যা খাদ্যপণ্য বিক্রি করে। সে যদি সততার সঙ্গে কাজ করে—যেমন, পণ্যের উপাদান সঠিকভাবে লেবেল করে, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য না বিক্রি করে এবং শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়—তাহলে তার ব্যবসা সমৃদ্ধ হবে।
ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যবসা শুধু ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, সমাজের উন্নয়নের জন্য। এই হাদিসটি আমাদের শেখায় যে, ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা আল্লাহর খলিফা। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত দারিদ্র্য দূর করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা।
যদি সকলে এই হাদিস অনুসরণ করে, তাহলে মুসলিম সমাজের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে এবং ইসলামের সৌন্দর্য বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
উপসংহারে
হাদিসটি ব্যবসায়ীদের জন্য একটি আলোকবর্তিকা। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সততা এবং ঈমানদারিতা ছাড়া কোনো ব্যবসা সফল নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই শিক্ষা আমাদেরকে উৎসাহিত করে যাতে আমরা ব্যবসাকে ইবাদতের মাধ্যমে পরিণত করি। যারা ব্যবসায়
নিয়োজিত, তারা এই হাদিসটি প্রতিদিন স্মরণ করুক এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করুক যাতে তাদের কাজে বরকত হয়। আল্লাহ আমাদের সকলকে সফল ব্যবসায়ী বানান যারা দুনিয়া-আখিরাত উভয় ক্ষেত্রেই লাভবান হবে






মাশাআল্লাহ
সিলসিলা এ ফুরফুরা শরীফ জিন্দাবাদ
সিলসিলা এ ফুরফুরা শরীফ জিন্দাবাদ